,

কাগজও দামের চূড়ায় :: বাজারে দেখা দিয়েছে কাগজ সংকট :: তৈরি পণ্যে গত এক সপ্তাহে ৩০ শতাংশের মতো দাম বাড়ছে

সময় ডেস্ক : সামনে বইমেলা আর জানুয়ারি মাসে নতুন বই লাগে স্কুল-কলেজে। ঠিক তখনই কাগজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে সরবরাহেও টান পড়েছে। এ সুযোগে হু হু করে বাড়ছে কাগজের দাম। তবে সব ধরনের কাগজের দাম একই হারে বাড়েনি। কাগজের নানা পদের মধ্যে টনপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। পাইকারিতে কাগজের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া চাহিদামতো কাগজও পাচ্ছেন না মুদ্রণশিল্পের মালিকরা।
এ পটভূমিতে পাইকাররা দোষ চাপাচ্ছেন কাগজকল মালিকদের ওপর। মিল মালিকরা বলছেন, ডলার ও বিশ্ববাজারে কাগজ তৈরির মন্ড বা ভার্জিন পাল্পের দর বাড়ার কারণে কাগজের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদনে ভজঘট তো আছেই। ফলে বাজারে কমেছে সরবরাহ। বাড়ছে কাগজের দাম।
রাজধানীর নয়াবাজার এলাকায় সরেজমিনে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে কাগজের দাম প্রতিদিনই বেড়েছে। হোয়াইট প্রিন্ট কাগজের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে টনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা বেড়ে দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। প্রতি টন হোয়াইট নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম বেড়েছে ১৫ হাজার টাকা। এ কাগজের দাম ২০ হাজার থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতিটন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়।
করোনা পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে কাগজ উৎপাদন কম হওয়া, ভার্জিন পাল্পের সংকট ও কাগজের আকাশছোঁয়া দরের কারণে আসছে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপার কাজও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপাতে প্রয়োজন হয় মোট এক লাখ টন কাগজ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কাগজের কাঁচামাল সংকটের কারণে দেশের মিলগুলো পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছে না।
এ ব্যাপারে মুদ্রণশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম, এখন ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’ কাগজের দর। দেশে এখন যে পরিমাণ কাগজ আছে তাতে সর্বোচ্চ ৩০-৪০ শতাংশ পাঠ্যবই ছাপানো সম্ভব হবে। পাঠ্যবইয়ের কাগজ উৎপাদন করে তিনটি পেপার মিল। তাদের কাছে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টন কাগজ উৎপাদনের পাল্প আছে। ৩৫ কোটি বই ছাপাতে লাগবে ১ লাখ টনের বেশি কাগজ। এখন কাগজ না থাকলে কী করে বই ছাপা হবে? তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কাগজ দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। বাজারে এখন পর্যন্ত কাগজের দাম কমেনি। তাই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থে বিদেশ থেকে কাগজ বা ভার্জিন পাল্প শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দেওয়া।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের এ সময়ে নতুন বই ছাপানোর জন্য প্রচুর কাগজের প্রয়োজন হয়। ফলে বাংলাবাজারের প্রকাশকরা বিভিন্ন ধরনের বই ছাপানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ কারণে এখন কাগজের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। অথচ কোনো কারণ ছাড়াই কাগজের দাম বাড়ছে। সরবরাহও কমেছে। আগে ১০০ টনের অর্ডার দিলে তিন-চার দিনের মধ্যে সরবরাহ করা হতো। এখন ১০০ টন কাগজ পেতে সময় লাগছে ৮ থেকে ১০ দিন। মিলাররা মূলত ডলার সংকট ও উৎপাদন সমস্যা দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে। বর্তমান বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। কাগজকলগুলোও এ সুযোগে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়াচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।
নয়াবাজারের ঢাকা পেপার হাউসের স্বত্বাধিকারী মো. মানিক বলেন, দাম বাড়ার পরও বড় চ্যালেঞ্জ হলো- টাকা দিয়েও কাগজ না পাওয়া। ২০ টনের অর্ডার দিলে মিলাররা দেয় ৮ থেকে ৯ টন। এ বাজারের মেসার্স রমনা ট্রেডার্সের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, মিলগেটে কাগজের দাম বেড়েছে। গত তিন-চার মাসে দুই থেকে তিন দফায় দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পাইকারি বাজারে।
বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক অনিল দাশ বলেন, আগে বিশ্ববাজারে প্রতি টন কাগজের দাম ১১শ থেকে সাড়ে ১১শ ডলার ছিল। কমে এখন ৯শ ডলারের নেমেছে। জাহাজ ভাড়াও কমেছে। অথচ বিদেশি কাগজের বুকিং কমে গেছে। এর মধ্যেই দেশে অনেক দাম বেড়েছে।
কাগজ উৎপাদন ও ব্যবসায়ীদের তথ্য বলছে, দেশে বছরে ৮ থেকে ৯ লাখ টন কাগজের প্রয়োজন হয়, যার অধিকাংশই দেশের উৎপাদনকারীরা সরবরাহ করে। এর মধ্যে আর্টপেপারসহ বিশেষ কিছু কাগজ আমদানি হয়। দেশে শতাধিক কাগজ কল ছিল। নানা কারণে ৬০ থেকে ৭০টি বন্ধ হয়ে গেছে।
গত দেড় বছরে নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম প্রায় ১৫০ শতাংশ বেড়েছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ছোটন। তিনি বলেন, গত বছরের জুন-জুলাইয়ে নিউজপ্রিন্ট কাগজের টন ছিল ৩২ থেকে ৩৩ হাজার টাকা। ডিসেম্বরের দিকে তা বেড়ে হয় ৪৭ থেকে ৪৯ হাজার টাকা। এরপর এ বছরের সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৭০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে।
দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে বাড়ার কারণে খুচরা বাজারেও কাগজের দাম লাগামহীন। খুচরা পর্যায়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লেখার কাগজ প্রতি রিম এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকায়, যা চার থেকে পাঁচ মাস আগেও কেনা গেছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। ফার্মগেটের তমা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আরিফ হোসাইন সমকালকে বলেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা বড় সিন্ডেকেট তৈরি করে রেখেছেন। এ কারণে কাগজের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। একই সঙ্গে কলমসহ শিক্ষার অন্য উপকরণের দামও বেড়েছে পাইকারি বাজারে। ২০০ পাতার একটি লেখার খাতা আগে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। ফটোকপির জন্য ব্যবহার করা হয়- এমন এ-ফোর আকারের এক রিম কাগজের দাম এখন ২৯০ টাকা, যা তিন-চার মাস আগে ছিল ২১০ থেকে ২২০ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বসুন্ধরা পেপার মিলের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কয়েক মাস আগেও বিশ্ববাজারে পাল্পের টন ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ ডলার। দাম এখন এক হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তাঁদের উৎপাদন কমেছে অন্তত ৪০ শতাংশ। এ কারণে কাগজের দাম বেড়েছে।


     এই বিভাগের আরো খবর